পরপর সাজানো সাতটি ক্যাপসুলের ঢাকনা আস্তে আস্তে খুলে গেল। মিটমিটে চোখে চারদিক চেয়ে দেখল পাঁচ জোড়া চোখ। মনে হচ্ছে যেন মূহুর্তকাল কিন্তু এরই মাঝে কেটে গেছে তিনশত বছর।
ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসল একে একে সবাই। একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে কি যেন বুঝতে চাইল। সবচেয়ে ছোট যে ছেলেটি বয়স হবে তার ষোলো বছর, দৌড়ে গেল মহাকাশযানটির কাচের জানালার কাছে।
তারা সবাই যখন ক্যাপসুলে প্রবেশ করে তখন ৩১৪০ সাল। মহাকাশযানটিতে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দ্বারা কাজ পরিচালনার জন্য সময় ও কাজ দিয়ে সেট করে দেওয়া হয় এবং সেই থেকে আজ ৩৪৪০ সাল পর্যন্ত মহাকাশযানটি নিজে নিজেই কাজ করেছে। সর্বশেষ কাজটি ছিল ক্যাপসুল পাঁচটি খুলে দেয়া। তা সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে যন্ত্রটি নির্বিকার হয়ে যায়। এখন মহাকাশযানটির নিয়ন্ত্রক এই পাঁচটি মানুষ।
জানালা দিয়ে পৃথিবীকে একটা ফুটবলের মত দেখাচ্ছে। কিন্তু এটাই কি তাদের বাসস্থল পৃথিবী? আতকে উঠল সবাই। সকল অবস্থান আর সূত্রের ভিত্তিতে এটাই পৃথিবী, সুপার সোনিক পাওয়ার কম্পিউটারেও তাই বলছে। কিন্তু পৃথিবীর সেই নীল সবুজ রঙ গেল কোথায়? কোথায় গেল সেই চিরচেনা অথচ সবার চেয়ে আলাদা এবং বিস্ময়কর গ্রহ? একে তো দেখতে এখন আর পাঁচটা গ্রহের মতই সাধারণ, শুষ্ক আর নির্জীব।
সোনালু,’আমার মনে হয় চোখে সমস্যা হয়ে গেছে, মানে কালার ব্লাইন্ড হয়ে গেছি হয়ত। সবুজ আর নীল রঙ দেখতে পাচ্ছি না।‘
সোহাগ,’আমরাও দেখতে পাচ্ছি না।‘
সোনালু,’মানে?’
আরিয়া,’মানে পৃথিবীর সব প্রাণ নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে।‘
সোনালু,’কি বলছেন এসব? তাহলে আমরা এখন কি করব? ৩০০ বছর ক্যাপসুলের ভেতর কাটালাম এই দিনটি দেখার জন্য?’
আরিয়া,’আমার ধারণা এমনটাই ছিল যে, মানুষ একদিন নিজেদের সাথে সাথে সমস্ত সভ্যতা, প্রাণী, উদ্ভিদ সব ধ্বংস করে ফেলবে।‘
সোনালু, ‘বলছেন কি এসব? মানুষ? মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী, আর তারাই কিনা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলল?’
সোহাগ, ‘বুঝলে সোনালু, সবই ভাগ্যের দোষ। প্রকৃতি নিজের সব রহস্যই মানুষকে জানাতে ইচ্ছুক নয়, তা জেনেও মানুষ তার সাথে পাল্লা দ্যায়।‘
আরিয়া,’অদৃষ্ট নয় সোহাগ। হিংসা, অহংকার, পরশ্রীকাতরতা, জেদ, লোভ ইত্যাদি অনুভূতির অভিশপ্ত ফসল।‘
অনিক,’পৃথিবীতে আর সবুজ উদ্ভিদ দেখতে পাবো না?’
আরিয়া,’তা নিচে গিয়েই দেখে আসি চলো।‘
পৃথিবীর বর্ণ এখন লাল গ্রহটির মত। তবে কালচে ভাবটা একটু বেশি। মহাকাশযানটি অনেক দ্রুত মাটিতে নেমে এল। চারিদিকে চেয়ে দেখার পর বিষণ্ণ মন আরো বিষিয়ে গেল। চতুরদিকে ধুলো-ময়লা , পাথর, প্লাস্টিক, কাচ, পলিথিনে ভরা। জানালা দিয়ে দেখেই বোঝা গেল সবই অর্ধপঁচা।
আরিয়া, ‘পৃথিবীতে এখন ওজন স্তর নেই, অক্সিজেনের পরিমাণও অনেক কম। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ মাটিতে আর বায়ুতে মিশে আছে যা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ‘
অনিক,’ কী এমন হয়েছিল আঙ্কেল?’
আরিয়া,’পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সারা বিস্বে যুদ্ধ হয়েছিল।‘
সবাই বিশেষ পোশাক পড়ে বাইরে বের হল। পা ফেলামাত্রই অনেকটা গেড়ে যাচ্ছে, ধূলোবালির পাহাড় যেন। যতদূর চোখ যায় শুধু নোংরা আবর্জনাই চোখে পরে। চারিদিকে শুধু হতাশা,কোন আশার আলো নেই। সেই শোকে হয়তো সূর্য তার আলো আর উত্তাপের পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড গরম। তাপমাত্রা প্রায় ৫৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
মুখে একরাশ ক্লান্তি আর হতাশা বয়ে নিয়ে মহাকাশযানে ফিরল সবাই। সবার মনে একটাই চিন্তা, তাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। তাদের সাথে সাথে হয়ত এই মহাবিশ্বও সম্পূর্ণ অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবে। তাদের কিছুই কি করার নেই?
সূর্য ডুবুডুবু। লাল সূর্যটা আগের চেয়ে অনেক বেশি রক্তিম। বাইরেটা এখনও অনেক গরম। অনেক বড় ও অধিক চাপ সহ্য করতে পারে এমন কাচের তৈরি জানালার ধারে বসে সবাই সূর্যাস্ত দেখছে।
সোহাগ,’কী অভূতপূর্ব দৃশ্য। এর আগে কখনও কেউ এমনটা দেখে নি। একটু পরেই আবর্জনায় তৈরি এ দুই পাহাড়ের ঠিক মাঝখানেই ডুবে যাবে সূর্যটি।‘
অনিক,’এক কাপ চা হলে খুব জমত।‘
সোনালু,’আমি এক্ষুনি বানিয়ে নিয়ে আসছি।‘
আরিয়া, ‘এটা মহাকাশযান। ‘
সোনালু,’তো?’
আরিয়া,’চা পাবে না, শুধু খাওয়ার জন্য ফুড ট্যাবলেট আছে, যা একটা খেলে ৬ মাস আর কিচ্ছু খেতে হবে না।‘
সবাই আশাহত হল। ৩০০ বছর পরের পৃথিবীটা হবে কত আকর্ষণীয়, কত সুন্দর, যোগাযোগ ব্যবস্থার এতো উন্নতি হবে যে, মানুষ তার নিজের ভেতরেই সমস্ত জায়গা আটকে রাখতে পারবে। কোন ঝামেলার উদ্রেক থাকবে না। কিন্তু এই ছিল পৃথিবীর ভবিষ্যৎ? এক নির্মম ভবিষ্যৎ!
সকাল বেলাতেই সূর্য উঠেছে দুপুর বেলার তেজে। মহাকাশযানটির ভেতরটিও অনেক আলোময় হয়ে উঠেছে। সবই প্রাকৃতিক আলো। খুব সুন্দর বেলি ফুলের মত সুবাস আসছে নাকে। আধো ঘুম চোখের পাতায় আলো-ছায়া খেলা করছে। এখনই যেন দোয়েল পাখি তার সুরে নিটল নিটল করে গান গাইবে। মায়ের রান্না করার প্রেসারটা মাঝে মাঝে শিস দিচ্ছে।
হঠাৎ করে টনক নড়লো আভাসের। তারা তো মহাকাশযানে রয়েছে, তাহলে শিস দেবে কিসে? বিছানা ছেড়ে ধড়ফড়িয়ে নামল, দ্রুত ঢুকল আরিয়ার ঘরে।
আভাস,’ক্যাপ্টেন, এই শব্দটা কিসের?’
ঘুম থেকে উঠেই এতো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। ঘুম জড়ানো চোখদুটি ভাল করে কচলে বোঝার চেষ্টা করল কে।
আরিয়া, ‘আভাস, কি হয়েছে?’
আভাস,’এই শব্দটা কিসের?’
আরিয়া,’কোন শব্দটা?’
আভাস,’আপনি শুনতে পান নি?’
আরিয়া,’না তো।’
আভাস,’এই যে শুনুন, কিছুক্ষণ পরপরই আসছে।’
আরিয়ার চোখদুটো বিস্ময়ে গোল হয়ে গেল।
আরিয়া, ‘সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো কমিউনিটি রুমে।’
আভাস,’আচ্ছা।’
দুজন একইসাথে দ্রুতবেগে ঘর থেকে বের হয়ে দুদিকে চলে গেল।
আরিয়া যোগাযোগের জন্য তৈরি অতি ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটারটি অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করল। কিছুক্ষণ আগেও প্রেশার কুকারের সিটি দেওয়ার আওয়াজ আসছিল, এখন বন্ধ। সবাই আরিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অতি উৎকণ্ঠা নিয়ে। নিশ্চই তিনি শ্বাসরুদ্ধকর কিছু বলবেন। পিন পতন নিরবতা বিরাজ করছে, সামান্যতম সময়টুকু পার করতেও ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছে। অবশেষে আরিয়া কম্পিউটার থেকে মুখ তুললেন।
সোনালু,’কি হয়েছে ক্যাপ্টেন? সবাইকে ডেকে পাঠালেন যে। আর এই শব্দটাই বা কেন আসছিল?’
আরিয়া,’তোমাদের ভয়েজারের কথা নিশ্চয় মনে আছে।’
সোহাগ,’হ্যা, আছে। ২০১১ সালে প্রথম মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়, এরপর থেকে প্রায় নিয়মিত বিভিন্ন কোডভিত্তিক নাম দিয়ে আরো উন্নত ভয়েজার মহাকাশে পাঠানো হয়। সর্বশেষ পাঠানো ভয়েজারটি ছিল ভয়েজার-১৮৬৬।’
আরিয়া,’মূলত, মহাবিশ্বে উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণী আছে কি না, এবং থেকে থাকলেও তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যই এটা মহাকাশে পাঠানো হয়।’
অনিক,’আমরা জানি, কিন্তু এখন কি হয়েছে সেটা তো বলুন।’
আরিয়া,’প্রায় ৫০০ বছর আগে পাঠানো ভয়েজারটি ছিল ভয়েজার-১১৩৯। সেটি প্রায় ৩৯ আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীরা পায় এবং তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য সিগনাল পাঠায় কিন্তু এতো দূর সিগনাল পাওয়া যায় না। তাই ভয়েজারে প্রেরণ করা তথ্য অনুযায়ী তারা আমাদের পৃথিবী অভিমুখে যাত্রা করেছে। প্রায় ৪ বছর মহাকাশ ভ্রমণ করার পর তারা আমাদের সৌরজগতের কাছে পৌঁছে এবং সেখান থেকেই সিগনাল দেওয়া শুরু করে। আর প্রায় ২ ঘন্টার মধ্যে তারা পৃথিবীতে পদার্পণ করবে।’
এক নিশ্বাস এতোগুলো কথা বলে থামল আরিয়া। চোখে মুখে তার হাসির রেখা ফুটে উঠল, এখন যেন তার মরতেও বাধা নেই। অন্তত মহাবিশ্বকে জানার জন্য আরো একদল বুদ্ধিমান প্রাণী আছে এই মহাবিশ্বে। হয়ত তারা বাদেও আরো অনেকে আছে।
সবার ভেতর কি এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেছে, বিস্ময়ে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কারো। ভয় নয়, তবুও শিরদাঁড়া ঠাণ্ডা পরশ বয়ে গেল। কাপাকাপা ঠোঁটে সবাই একযোগে বলে উঠল, ‘সত্যি?’